
কুয়াকাটায় সাগর কন্যার সান্নিধ্যে

ঘুরে এলাম কুয়াকাটা, সান্নিধ্য পেলাম সাগরকন্যার, উপভোগ করলাম প্রকৃতির অকৃপণ হাতে গড়া সৌন্দর্যের লীলাভূমির প্রতিটি দৃশ্যকাব্য। আর সাথে করে নিয়ে এলাম পরিবর্তিত জীবনানুভুতি। সাগরের বিস্তৃত জলরাশির সান্নিধ্য না পেলে বুঝতেই পারতামনা অকৃপণতা কাকে বলে। সাগরের নোনা জলে নেমে না সাঁতরালে জানতেই পারতামনা বিশালতা কাকে বলে! একঘেয়েমি জীবনে কিছুটা বৈচিত্রের স্বাদ নিতে আমরা তিন সহকর্মী কুয়াকাটা ভ্রমনের সিদ্ধান্ত নিলাম । হাইওয়ে ধরে একটু একটু করে এগিয়ে যেতে থাকলাম কুয়াকাটার দিকে। হাইওয়ের দু’পাশে বিস্তৃত মাঠগুলির দিকে তাকালে চোখ ফেরানোয় দায়! হেমন্তের ঝিরঝিরে বাতাস হালকা শীতের সোনাঝরা রোদকে সাথে নিয়ে সোনালী আমন ধানের ক্ষেতে অবিরত ঠেউ তুলে চলেছে আর তাকে সাথে নিয়েই এগিয়ে চলেছি আমরা। প্রকৃতির অবিরাম সৃষ্টিশীলতাকে সাথে করে নিয়েই আমরা্ হাজির হলাম প্রকৃতির আরও নিবিড় সান্নিধ্যে।
অবশেষে বরগুনা থেকে কয়েক ঘন্টার মোটর সাইকেল যাত্রার পর ভর দুপুরে আমরা পৌঁছে গেলাম আমাদের কাঙ্খিত ঠিকানায়। দুপুরের তপ্ত রোদকে উপেক্ষা করে উঁচু বাঁধ পেরিয়ে নীচে নামতেই সাগর কন্যার বিশাল জলরাশি তার স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে বিপুল উৎসাহ নিয়ে প্রবল ঢেউয়ের শব্দে স্বাগত জানাল আমাদেরকে । এক দিকে সমুদ্রতটের চিকচিকে বালির বর্ণিল শেভাযাত্রা আবার তারই সামনে বিপুল বিশাল জলরাশির সগর্ব উপস্থিতি । আর এই দুই ঘরানার দুই শিল্পীকে তাদের নিজস্ব দৃশ্যকল্প ফুটিয়ে তুলতে অবিরত সহায়তা করে চলেছে সদা হাস্যোজ্জ্বল সূর্যের সরব উপস্থিতি। সূর্যের তেজোদীপ্ত আলোকরশ্মি আর সমুদ্রের জলরাশির অবাধ মিতালী যে অভাবনীয় দৃশ্যকাব্য সৃষ্টি করে চলেছে তার পরতে পরতে ছড়িয়ে আছে সৃষ্টিশীলতার এক অনুপম নিদর্শন। দেদীপ্যমান সূর্যালোকের উপস্থিতিতে দূর থেকে সাগরের দিকে তাকালে মনে হয়, সদা জাগরুক তারকারাজি রাতের আঁধারকে ফাঁকি দিয়ে সাগরের বুকে আশ্রয় নিয়ে চিকচিক করে জ্বলছে আর মনোরঞ্জন করে চলেছে হাজারো পর্যটককে। সমুদ্রের তীর ঘেঁষে বেড়ে ওঠা ঝাউগাছগুলো কুয়াকাটার সৌন্দর্যের নান্দনিকতায় এক আলাদা মাত্রা যোগ করেছে। অপরাহ্নে সূর্য অস্ত যা্ওয়ার মুহুর্তটিতো এক কথায় অনবদ্য। সূর্য ডোবার দৃশ্য দেখতে দেখতে মনে হল আপাত ঘূর্ণায়মান সূর্যদেব তার পরিক্রমা শেষ করে ধীরে ধীরে তার নিজস্ব দীপ্তিটাকে ক্ষীণ করতে করতে এক সময় ডিমের কুসুমের আকার ধারণ করল এবং এক লহমায় মিশে গেল সাগরের অতল তলে, এক নতুন ভোরের প্রত্যাশায়।
পূর্ণিমার চাঁদের মায়াবী আলোর উপস্থিতি সাগরের বুকে যেন এক নতুন প্রাণস্পন্দন এনে দেয়। সাগরের বুক জুড়ে উৎপন্ন ছোট ছোট ঢেউগুলি রাতের আঁধার ভেদ করে তীরে এসে ধাক্কা খা্ওয়ার ফলে যে আলোকচ্ছটার বর্ণিল উপস্থিতির আবাহন ঘটায়, তা যেন আমাদের বর্তমান জাতীয় জীবনের এক উজ্জ্বল প্রতিচ্ছবি। আমাদের জাতীয় জীবনে আজ ঘোর অমানিশা, চারিদিকে বিভেদের দেওয়াল, অনৈক্যের সুর। তারপরও আমাদের দেশ এগিয়ে চলেছে। আমাদের চারপাশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা সাদা মনের মানুষগুলোর কর্মকান্ড যখন সমুদ্রের ছোট ছোট ঢেউয়ের মতো একত্রিত হয়ে সামনে এগিয়ে আসবে তখন হয়তো দেখা যাবে আঁধার কেটে গেছে, অশুভ শক্তি বিদায় নিয়েছে আর চারদিকে ঝলমল করছে জ্ঞান আর প্রজ্ঞার দীপ্তি।
কুয়াকাটার রাখাইন পল্লীতে ঘুরে রাখাইনদের জীবনযাত্রা অবলোকন না করলে বুঝতেই পারতামনা বৈচিত্রময়তা কাকে বলে! রাখাইনরা এই একুশ শতকের যান্ত্রিকতার মোড়কে আবর্তিত জীবনধারাকে সযত্নে দূরে সরিয়ে রেখে এখনও যে তাদের চিরকালীন সহজ-সরল অথচ বৈচিত্রময় জীবনযাত্রাকে আঁকড়ে ধরে আছে তা আমাদের এই তথাকথিত নগর সভ্যতার অধিবাসীদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়, ভালো থাকার জন্য খুব বেশি কিছু লাগেনা। শুধুমাত্র সরল জীবন দর্শন, আন্তরিকতা আর প্রকৃতির ভাষাটুকু বুঝতে পারলে অনেকটাই ভালো থাকা যায়। আর এরসাথে আমরা যদি ষড় রিপুর অন্যতম কান্ডারী ‘‘লোভ’’ নামক প্রপঞ্চটিকে সযত্নে দুরে সরিয়ে দিতে পারি তাহলে আমাদের এই ঝঞ্জাবিক্ষুব্ধ মানব সভ্যতা আবার নব উদ্যমে এগিয়ে যাবে নব আশার সাথে।
কুয়াকাটা ভ্রমনে সবচেয়ে দৃষ্টি সুখকর অভিজ্ঞতা হলো সূর্যোদয়ের মুহুর্তটিকে অতি কাছ থেকে অবলোকন করা । কুয়াকাটাতে সূর্যোদয়ের দৃশ্য সবচেয়ে ভালো দেখা যায় গঙ্গামতির চর থেকে। আর তাই হাজারো পর্যটকের মতো আমরাও ভোরের মায়াবী ঘুমকে বিদায় জানিয়ে সেই আকাঙ্খিত অনিন্দ্য সুন্দর দৃশ্য অবলোকন করার মানসে খুব ভোরে পৌঁছে গেলাম গঙ্গামতির চরে । পরিপূর্ণ জোয়ারের উপস্থিতিতে অন্য মাত্রা পাওয়া সাগরের গর্জনকে সাথে নিয়ে পুবের আকাশ ধীরে ধীরে রঙিন হতে শুরু করল। সূর্যদেব নিজেকে পরিপূর্ণ রুপে প্রকাশ করার পূর্বেই লাল আভা পুব আকাশে ছড়িয়ে দিয়ে জানিয়ে দিল তার আগমনী বার্তা। হাজারো চোখকে ফাঁকি দিয়ে ভোরের কুয়াশা ভেদ করে সমুদ্র মন্থন শেষে সূর্যদেব এক লহমায় উদিত হলেন পুব আকাশে। ধীরে ধীরে সূর্যের দীপ্তিময় আভা ছড়িয়ে যেতে লাগল চারিদিকে…ভোরের আঁধার একটু একটু করে দূরে সরে যেতে লাগল আমাদের চারপাশ থেকে…ভোরের নরম আলোয় সূর্যস্নান হয়ে গেল আমাদের, মনটাও হয়ে উঠল পবিত্র। পুব আকাশে উদিত সূর্য আমাদের মনে এই আশাবাদ সঞ্চার করে দিল, যতই আঁধার আসুক, হতাশ হয়ো না, আলো আসবেই!